রাজ-কাহিনী ১

ঝিরঝির বাতাস। বিকেলের সূর্য নরম রোদ ঢালছে পৃথিবীর নগ্ন গায়ে। কিন্তু হাসনপু্রের রাজধানী হীরনের বাইরের প্রান্তরে কোন কিছুই আজ প্রবেশ করছে না, মাটি ঢাকা ধূলার তাণ্ডবে, যোদ্ধাদের পদবিক্ষেপে। নানাবিধ হুংকারের পাশেই, শেষ দুর্গের মাথায়, দুজনকে দেখা যাচ্ছে অস্ত্রধারী। একজন লম্বা, পেশীবহুল, শ্মশ্রুবিশিষ্ট, অন্যজন অনেকটা খাটো, বয়েসেও অপেক্ষাকৃত ছোটো।

“অস্ত্র ফেলে দিন কুমার। আপনার সৈন্যদল নিশ্চিহ্ন।“ পেশীবহুল মানুষটি বললেন।

“প্রাণ থাকতে আত্মসমর্পণ নয় !” চেঁচিয়ে উঠলেন চন্দ্রকুমার। নির্লোম গালে স্বেদবিন্দুর সাথে মিশে আছে শত্রু রক্তের দাগ। ফরসা কপালে কোঁকড়ানো চুল অবিন্যস্ত- কিশোর শরীর ফুলে উঠছে রাগে, উত্তেজনায়। “আর আপনার একটু ভুল হয়ে গেল, মীহন রাজ ।“

চোখ একটু সরু হল মীহন রাজ বিঘ্নকের।“কি ভুল ?”

“আমার সৈন্যদলের চেয়ে আপনার মস্তকের দাম ঢের বেশী। সম্মুখ সমরে আসা আপনার উচিত হয় নি, রাজা। আপনার শিরশ্ছেদের পর জয় কিন্তু আমারই হবে।“ তরবারী চালালেন চন্দ্রকুমার।

“বালক !” মৃদু হাসলেন বিঘ্নক। ঝলসে উঠল তাঁর তরবারী, কয়েক পলের মাঝেই খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেল চন্দ্রকুমারের তলোয়ার। পেট লক্ষ্য করে পা চালালেন পলকে বিঘ্নক। ছিটকে পড়লেন চন্দ্র।

“কুমার, এখনো লড়াই করতে চান ? আপনার অস্ত্র ভেঙে গেছে। আপনি চাইলে আমরা খালি হাতে যুদ্ধ জারী রাখতে পারি। বীর যোদ্ধাদের মতন। অবশ্য আপনি নিতান্ত বালক, বীরধর্ম শিক্ষা…”

“হাসনপুরের কুলদেবীর দিব্যি, এই অপমানের শোধ আপনার রক্তেই হবে !” ঝাপিয়ে পড়লেন চন্দ্র, বিঘ্নকের ওপর। ভূলুণ্ঠিত হয়ে গড়াতে লাগলেন দুজনেই। আচম্বিতে উঠে এল বিঘ্নকের হাত, নির্দিষ্ট কোণে আঘাত করল চন্দ্রের ঘাড়ে। শরীর শিথিল হয়ে এল চন্দ্রের। দুহাতে ওর শরীর টা তুলে নিলেন বিঘ্নক, আছড়ে দিলেন পাশে। “আরো লড়াই করবে, ছোট্ট কুমার ?”

“আমি… আমি…” নড়বার চেষ্টা করতে করতেই অন্ধকার হয়ে এল চন্দ্রের চোখ।

“মহারাজ হীরণ্য, দুঃসংবাদ।“

“জানি মন্ত্রীবর। রাজধানীর বাইরে আমাদের সৈন্যদল পরাজিত। কিন্তু আপনি এত চিন্তা করবেন না। আপনি ত জানেনই, পুরুষকার কিংবা জাদুবলে এই প্রাকারের ভেতর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বিঘ্নক ত এসব জানে না। থাকুক কিছুদিন বাইরে অবরোধ করে, নিজেই তারপর রণে ভঙ্গ দেবে। তাছাড়া, বিগত রাজাদের আক্রমণাদির সময় তাও কিছু চিন্তা ছিল। কেউ কোনোভাবে যদি রাজকন্যাকে অপহরণ করে তাঁর সাথে… কিন্তু আমার ত কোনো কন্যাও নেই, সমস্যাও নেই।“

নতমুখে চুপ রইলেন মহামন্ত্রী। ঠোঁট আচমকা কেঁপে উঠল রাজার। “কি হল মন্ত্রী ? চন্দ্র—”

“হ্যাঁ মহারাজ। কুমার বারণ স্বত্ত্বেও বেরিয়েছিলেন প্রাকারের বাইরে। সম্ভবত যুদ্ধে তিনি মারা গেছেন।“

বসে পড়লেন রাজা নীচে। এগিয়ে এলেন মন্ত্রী, “এখনই ভেঙে পড়বেন না রাজন। হয়ত বিঘ্নক ওনাকে বন্দী করেছেন। সেক্ষেত্রে আপনি ত বুঝতেই পারছেন, দেবীর বরে পাঁচদিন বাদে উনি নিজেই ফিরে আসবেন।“

“হ্যাঁ। যদি সে বেঁচে থাকে।“ ধীরে ধীরে বললেন রাজা। অপেক্ষা ত করতেই হবে।

চন্দ্রকুমারের জ্ঞান ফিরল মাটির তলার কোনো ঘরে। কোথাও কোনো আসবাব নেই। হলদেটে দেয়ালের পেছন থেকে আশ্চর্য কোনো আলো আসছে। মাটিতে উঠে বসল সে। অদ্ভুত, শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, ব্যথা নেই। শুধু কেমন আচ্ছন্ন হয়ে আছে গোটা গা। আচ্ছা, রাজবেশ, বর্ম গেল কই ? কটিবন্ধ বাদে সমস্ত নিরাভরণ শরীর।

উঠে দাঁড়াল চন্দ্র। এগিয়ে গেল ঘরের একমাত্র দরজার দিকে। কাঠে হাত রেখে, উৎকর্ণ হয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করল সে। নাঃ, কিচ্ছু নেই। এমন জায়গায় তাকে বন্দী করার মানে কি ? নিশ্চয় তার মুক্তির বিনিময়ে রাজ্য চাইবে ওই বিঘ্নক টা। সে জানে না, কুলদেবীর বরে সে আশায় তার বালি। রাজা কয়েকদিন বিলম্ব করাবেন, আর পাঁচদিনের দিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সে এখান থেকে অদৃশ্য হয়ে সোজা নিজের ঘরে। নিজের মনেই হেসে একবার গালে হাত বুলিয়ে নিল চন্দ্র। ষোল বছর হয়ে এলেও দাড়ি আসে নি গালে, এটা তার এক গোপন হীনমন্যতা।

অকস্মাৎ গলায় হাত যেতেই চমকে উঠল সে। একী, গলার মাঝ বরাবর এত মসৃণ কি এটা ? নিজের গলা নিজে ত দেখা সম্ভব নয়, ঘরে দর্পণও নেই। কিন্তু কিছু একটা ত ওখানে আছেই। এবং বাইরের কিছু নয়, যেন চামড়াই নিজে থেকে বদলে গেছে ওখানটায়।

অস্বস্তির মাঝেই শব্দ হল দরজায়। কেউ আসছে। গম্ভীর এবং স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে রইল চন্দ্র। বিঘ্নক ! পেছনে একজন পরিচারিকা এসে একটি চৌপায়া কাষ্ঠাধারে খাবার এবং পানীয় রেখে গেল তার সামনে। ছোটো ঘাগড়াটি হাঁটুর সামান্য নীচে এসে সমাপ্ত হয়েছে, এবং ঊর্ধ্বাঙ্গ পূর্ণ অনাবৃত। উঁচিয়ে আছে দুটি নিলাজ স্তন। আর না তাকিয়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল চন্দ্র গম্ভীর। নিজের কাজ শেষে পরিচারিকাটি বিঘ্নকের সামনে একবার মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেলো। মেয়েটি রূপসী, স্বীকার করতেই হল চন্দ্রকে।

“কেমন আছেন, বীর কুমার ?” কোমরে এক হাত রেখে প্রশ্ন করল বিঘ্নক। তারও ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। কালো সুঠাম শরীরে পেশীর আভা ফুটে উঠছে প্রবল।

“রাজবন্দীকে যেমন রেখেছেন। “ শান্তভাবেই বলল চন্দ্র। যদিও ভেতরে সে উত্তেজিত।

“যাঃ। আপনি রাজবন্দী নন। এটা আপনারই ঘর ভাবুন। আমার ঘর ত আপনারো ঘর।“

“একটু বেশী কল্পনা করছেন মীহনরাজ। রাজধানীতে আপনি পা-ও রাখতে পারবেন না। হাসনপুর গত পাঁচশ বছর অজেয় আছে, অজেয়ই থাকবে।“

মৃদু হেসে এগিয়ে এল বিঘ্নক। হাত রাখল চন্দ্রের চিবুকে। “আগামী পাঁচশ বছর হাসনপুর বলে কিছু থাকবেই না। হীরন শহরের নাম পালটে আমি রাখব বিঘ্নকগড়। প্রত্যেক হাসনপুরী গর্ভে একজন মীহান জন্ম নেবে। তোমাদের ওই কুলদেবীর মূর্তি সরিয়ে ওখানে প্রতিষ্ঠা হবে-“

“নরকের কীট ! দেবীর গায়ে হাত দিলে তোকে-“

হঠাত ধাক্কায় ছিটকে গেল বিঘ্নক, চৌপায়া উল্টে ছড়িয়ে গেল সমস্ত। চন্দ্র দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চড়ে বসেছে বিঘ্নকের বুকের ওপর। গলাটা টিপে ধরতে চাইল সে। কিন্তু আশ্চর্য, শুধু হাসি দিল বিঘ্নক। “তুমি আমায় আঘাত করতে পার না, প্রিয়।“

গলায় একটা জ্বালা। আর অদ্ভুত। পারছে না। কিছুতেই বিঘ্নকের গলায় জোর দিয়ে চাপতে পারছে না চন্দ্র।

Comments:

No comments!

Please sign up or log in to post a comment!